আঙ্গুয়া গ্রামের দাস মহাপাত্র বাড়ির দুর্গাপুজো, জানুন এই পুজোর ইতিহাস

মহাপাত্র

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন ১নম্বর ব্লকের ঘোলাই গ্রাম পঞ্চায়েতের আঙ্গুয়া গ্রামের দাস মহাপাত্র বাড়ির দুর্গাপুজো। ( panchayat ) জানা গিয়েছে আনুমানিক ১৭৪২ সালে শুরু হয়েছিল এই পরিবারের দুর্গাপুজো। আজও আঙ্গুয়া গড়ের “দাস মহাপাত্র” বাড়ির এই পুজো এলাকার মানুষের মন টানে। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে ওড়িশার কটকের খোরদার থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন বিরিঞ্চি মহান্তি।দাঁতনের ঘোলাইয়ের কাছে এসে পথভ্রষ্ট হন তিনি। সংজ্ঞাও হারিয়ে ফেলেন ।

 

এলাকার ব্রাহ্মণ জমিদার তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।আর কোথাও যাননি বিরিঞ্চি মোহান্তি। থেকে যান ব্রাহ্মণের কাছেই, সেরেস্তায় কাজ সামলাতে শুরু করেন । ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন বিরিঞ্চি মোহান্তি। ব্রাহ্মণের বৃদ্ধাবস্তা আসার পূর্ব মুহূর্তে ব্রাহ্মণ কাশী যাত্রা করার সংকল্প গ্রহণ করেন । তখন তিনি বিরিঞ্চি বাবুকে তাঁর জমিদারি লিখে দিতে চান। কিন্তু বিরিঞ্চি মোহান্তি ছিলেন একজন সত্‍ ব্যক্তি। তিনি ব্রাহ্মণকে বলেন তাঁর মেয়েকে অর্ধেক জমিদারি এবং তাঁকে অর্ধেক জমিদারি দিতে।

 

বিরিঞ্চি বাবুর কথা মতো ব্রাহ্মণ জমিদার তার মেয়ে এবং বিরিঞ্চি মোহান্তির মধ্যে জমিদারি সমান ভাগে ভাগ করে দেন। এর পরই কাশী যাত্রা করেন ব্রাহ্মণ। কথিত আছে বহু দিন ব্রাহ্মণ পরিবারের সাথে থাকার দরুন ব্রাহ্মণের কন্যার সাথে বিরিঞ্চি মোহান্তির প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল। ব্রাহ্মণ কন্যা বিরিঞ্চি বাবুকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন,কিন্তু বিরিঞ্চি মোহান্তি ছিলেন জাতিতে কায়স্থ।

 

তাই তিনি ব্রাহ্মণ কন্যার প্রস্তাবে রাজি হননি। এর পর বিরিঞ্চি বাবু নিজেই ব্রাহ্মণ কন্যাকে কেশিয়াড়ি ব্লকের পতি পরিবারে বিয়ে দেন। অর্ধেক জমিদারি সত্তা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যান ব্রাহ্মণ কন্যা। আর অর্ধেক জমিদারি সত্তা নিয়ে ঘোলাইয়ের পলাশিয়া তে থেকে যান বিরিঞ্চি মোহান্তি।

 

আর ও  পড়ুন    আফগান সীমান্তে এবার মোতায়েন করা হচ্ছে ‘মানববোমা’!

 

এরপর জমিদার বিরিঞ্চি মোহান্তি সংসারী হন। দুই পুত্র সন্তানের বাবা হন বিরিঞ্চি বাবু। আবার ভাগ হয় জমিদারি। বড় ছেলে আনা জমিদারি নিয়ে থেকে যায় পলাশিয়া গ্রামে আর ছোট ছেলে ছ আনা জমিদারি নিয়ে চলে আসেন আঙ্গুয়া গ্রামে।

 

৬ আনা জমিদারি নিয়ে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে বিরিঞ্চি মোহান্তির ছোট ছেলের জমিদারিতে। এই জমিদারির উত্তরসূরিদের মধ্যে রূপনারায়ণ দাস মহাপাত্র শুরু করেন দুর্গাপুজো। মোহান্তি থেকে দাস মহাপাত্র এই বিষয়ে একটি প্রবাদ রয়েছে । ইংরেজরা মোহান্তি জমিদারদের দাস মহাপাত্র উপাধি দিয়েছিল অচিরে সেই উপাধি আজ পদবিতে পরিণত হয়েছে।

 

 

তদানিন্তন রাজার কাছ থেকেও চৌধুরী উপাধি লাভ করেছিল এই পরিবার ।সেই থেকে এই পরিবারের কেউ কেউ আবার চৌধুরীও পদবি হিসেবে ব্যবহার করেন। এই পরিবারের শেষ জমিদার জাদবেন্দ্র চৌধুরীর আমলে এই দুর্গাপুজোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।তবে জমিদারী প্রথা উঠে গেলেও দাস মহাপাত্র বাড়ির দুর্গাপুজোর রীতি থেমে থাকেনি। উত্তরসূরিরা প্রথা মেনে নিষ্ঠার সাথে এই পুজোকে আজও চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

দাস মহাপাত্র বাড়ির এখনকার বর্তমান উত্তরসূরী দের কথায় জমিদার আমলে যে নিয়ম ও রীতি মেনে পুজো হতো সেই নিয়ম ও রীতি আজও অব্যাহত রয়েছে ।এই পুজোর আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে । ষষ্ঠী থেকে নয় প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দাস মহাপাত্র বাড়ির দুর্গোত্‍সব। সৈকত দাস মহাপাত্র জানান নবরাত্রি থেকে শুরু হয় তাঁদের পরিবারের এই উত্‍সব। প্রত্যেক দিন মায়ের কাছে দেড় কুন্টেল ধানের খই মোয়া এবং লুচি মিষ্টি দেওয়া হয়। যা এই পরিবারের কেউ গ্রহণ করেন না সবই দর্শনার্থীদের দিয়ে দেওয়া হয় ।

 

তাঁদের মতে মেয়েকে দেওয়া জিনিস বাপের বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয় না। পরিবারের এই পুজোর উপদেষ্টা প্রণব দাস মহাপাত্র জানান গ্রামের মানুষেরা এই পুজোকে নিজের বাড়ির পুজো মনে করেন । পুজোকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান তথা যাত্রা পালা গানের পাশাপাশি মায়ের মঙ্গল গান ভারত গান এবং চণ্ডীমঙ্গল গানের আয়োজন করা হয়।

 

বিশেষ করে জমিদার আমল থেকেই এই পুজোয় নবমীতে মহামারী পুজো চলে আসছে আজও। তত্‍কালীন, মহামারী থেকে প্রজাদের রক্ষা করার জন্য এই মহামারী পুজো করা হত নবমীতে যা আজও দুর্গাপুজোর মহানবমীতে অনুষ্ঠিত হয়। সৈকতবাবু প্রণববাবুর পাশাপাশি অমিতাভ দাস মহাপাত্র, সমীর দাস মহাপাত্র, দীপক দাস মহাপাত্র এবং শৈশব দাস মহাপাত্র চালিয়ে যাচ্ছেন এই পুজো।